মাত্র ৩৫ বছর বয়স, কিন্তু হার্ট অ্যাটাক! -এই ধরনের সংবাদ আজকাল প্রায়ই দেখা যায়। হৃদরোগ, যা একসময় শুধু প্রবীণদের সমস্যা বলে মনে করা হতো, এখন তরুণদের মধ্যেও ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ হৃদরোগজনিত কারণে মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর ৩২%। বাংলাদেশেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক -একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রতি চারজনের একজন কোনো না কোনো হৃদরোগে ভুগছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হার্টের সমস্যা গুলো কি কি? কেন এত দ্রুত এই রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে?
হার্টের সমস্যাগুলো কেবল হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকেই সীমাবদ্ধ নয়। উচ্চ রক্তচাপ, আর্টারির ব্লকেজ, হৃদস্পন্দনের অনিয়ম (Arrhythmia), এমনকি জন্মগত হৃদরোগও ভয়ানক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো, বেশিরভাগ মানুষ এই রোগগুলোর লক্ষণ সম্পর্কে অবগত নয় এবং যখন সচেতন হয়, তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই এখন সময় এসেছে হৃদরোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে গভীরভাবে জানার। আমাদের আজকের আর্টিকেলে আমরা সে সম্পর্কেই বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করব।
কেন হার্টের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে?
দিন দিন হার্টের সমস্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক চাপ। আধুনিক জীবনযাত্রায় দ্রুতগতির জীবনধারা ও ব্যস্ততা মানুষের খাদ্যাভ্যাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত চর্বি ও প্রসেসড খাবারের আধিক্য রক্তনালিতে কোলেস্টেরল জমার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়, যা হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য হৃদরোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া, শারীরিক পরিশ্রমের অভাবও এক বড় সমস্যা। বেশিরভাগ মানুষই দৈনন্দিন ব্যস্ততার কারণে নিয়মিত ব্যায়াম করতে পারেন না, যার ফলে শরীরে মেদ জমে, রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
অন্যদিকে, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা হৃদরোগ বৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রের চাপ, পারিবারিক সমস্যা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, যা সরাসরি হার্টের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি ধূমপান ও অ্যালকোহলের মতো ক্ষতিকর অভ্যাস হার্টের সুস্থতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণ একত্রে মিলে হার্টের সমস্যা দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে এবং এটি প্রতিরোধে সচেতনতা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার বিকল্প নেই।
হার্টের সমস্যা গুলো কি কি
করোনারি আর্টারি ডিজিজ
করোনারি আর্টারি ডিজিজ হলো হৃদরোগের সবচেয়ে সাধারণ ধরন, যা তখন ঘটে যখন হৃদযন্ত্রে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে (করোনারি আর্টারি) চর্বি, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য পদার্থ জমে ব্লক তৈরি করে। এই ব্লকের ফলে ধমনী সংকুচিত হয়ে যায় এবং হৃদপিণ্ড পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। এই সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেলে রোগী বুকে ব্যথা (অ্যাঞ্জাইনা) অনুভব করতে পারে এবং চরম পর্যায়ে এটি হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, স্থূলতা এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এই রোগের অন্যতম কারণ।
এই রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে বুকে চাপ বা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অবসাদ ও দুর্বলতা অন্যতম। অনেক সময় রোগীরা বুঝতেই পারেন না যে তাদের এই সমস্যা রয়েছে, কারণ কিছু ক্ষেত্রে এটি নিঃশব্দে বিকশিত হয় এবং হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের মাধ্যমে ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য সাধারণত জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ওষুধ সেবন, স্টেন্ট বসানো অথবা বাইপাস সার্জারি করা হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ প্রতিরোধ করা গেলে বড় ধরনের জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
হার্ট অ্যাটাক
হার্ট অ্যাটাক ঘটে যখন হৃদযন্ত্রের কোনো অংশে রক্ত সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ঐ অংশের টিস্যু অক্সিজেনের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণত করোনারি আর্টারি ডিজিজের কারণে এই সমস্যা হয়, যেখানে ধমনীতে জমে থাকা চর্বি এবং রক্ত জমাট বাঁধার ফলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ এবং মানসিক চাপ এই রোগের প্রধান কারণ।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো সাধারণত তীব্র এবং হঠাৎ করে দেখা দেয়। প্রচণ্ড বুকে ব্যথা, যা হাত, ঘাড় বা পিঠে ছড়িয়ে যেতে পারে, অতিরিক্ত ঘাম, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব ও মাথা ঘোরা ইত্যাদি এই রোগের সাধারণ লক্ষণ। দ্রুত চিকিৎসা না পেলে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। চিকিৎসার জন্য ইমারজেন্সি ওষুধ, এনজিওপ্লাস্টি, স্টেন্ট বসানো বা বাইপাস সার্জারি করা হয়। জীবনধারার পরিবর্তন এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
হার্ট ফেইলিউর
হার্ট ফেইলিউর তখন ঘটে যখন হৃদযন্ত্র তার স্বাভাবিক ক্ষমতা অনুযায়ী রক্ত পাম্প করতে পারে না, ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। এটি সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি আর্টারি ডিজিজ, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য হৃদরোগের জটিলতা থেকে সৃষ্টি হয়। হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়লে শরীরে তরল জমে যায়, যা ফুসফুস, কিডনি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যকারিতা ব্যাহত করে।
হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণগুলোর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, শরীর ফুলে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হলেও, এটি যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে তবে হৃদযন্ত্র মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে যায় এবং জীবনযাত্রার মান ব্যাহত হয়। চিকিৎসার জন্য ওষুধ সেবন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা উন্নত করা যেতে পারে।

আরিথমিয়া
আরিথমিয়া হলো হৃদস্পন্দনের অনিয়মিত গতি, যা খুব ধীর (Bradycardia) বা খুব দ্রুত (Tachycardia) হতে পারে। এটি তখন ঘটে যখন হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক সংকেত সঠিকভাবে কাজ করে না, ফলে হৃদস্পন্দনের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি তেমন ক্ষতিকর না হলেও, কখনো কখনো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন স্ট্রোক বা হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
আরিথমিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথা ঘোরা, বুকে অস্বস্তি, শ্বাসকষ্ট ও দুর্বলতা অন্তর্ভুক্ত। অনেক সময় এই সমস্যা জন্মগত হতে পারে, আবার দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ বা মানসিক চাপ থেকেও হতে পারে। চিকিৎসার জন্য সাধারণত জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ওষুধ সেবন, পেসমেকার বসানো বা ক্যাথেটার অ্যাব্লেশন ব্যবহার করা হয়।
ভালভুলার হার্ট ডিজিজ
ভালভুলার হার্ট ডিজিজ হলো হৃদযন্ত্রের ভালভের সমস্যাজনিত রোগ, যেখানে হৃদযন্ত্রের ভালভ ঠিকমতো খোলা বা বন্ধ হতে পারে না, ফলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এটি জন্মগত হতে পারে অথবা ইনফেকশন, রিউমাটিক ফিভার, বয়সজনিত অবক্ষয় ও অন্যান্য হৃদরোগের কারণে সৃষ্টি হতে পারে। হৃদযন্ত্রের চারটি ভালভের মধ্যে যেকোনো একটিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা রক্ত প্রবাহের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায়।
ভালভুলার হার্ট ডিজিজের লক্ষণগুলোর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, দুর্বলতা, ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, ও পায়ে ফোলাভাব অন্তর্ভুক্ত। এই রোগ যদি দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি হার্ট ফেইলিউর বা অন্যান্য মারাত্মক জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। চিকিৎসার জন্য সাধারণত ওষুধ সেবন, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং কিছু ক্ষেত্রে ভালভ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি করা হয়।
কার্ডিওমায়োপ্যাথি
কার্ডিওমায়োপ্যাথি হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে হৃদযন্ত্রের পেশিগুলো দুর্বল বা অস্বাভাবিক হয়ে যায়, ফলে হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না। এটি প্রাথমিকভাবে জেনেটিক কারণেও হতে পারে, তবে উচ্চ রক্তচাপ, সংক্রমণ, মদ্যপান, ডায়াবেটিস বা হার্ট অ্যাটাকের কারণেও হতে পারে। এই রোগের তিনটি প্রধান ধরন রয়েছে: ডাইলেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Dilated Cardiomyopathy), যেখানে হার্টের পেশি দুর্বল হয়ে ফোলা যায়; হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Hypertrophic Cardiomyopathy), যেখানে হৃদযন্ত্রের দেয়াল ঘন হয়ে যায় এবং রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে; এবং রেস্ট্রিকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Restrictive Cardiomyopathy), যেখানে হার্টের পেশি শক্ত হয়ে যায় এবং প্রসারিত হতে পারে না।
এই রোগের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, পা ও গোড়ালি ফোলা, বুক ধড়ফড় করা এবং মাথা ঘোরা অন্তর্ভুক্ত। কার্ডিওমায়োপ্যাথি যদি দীর্ঘদিন চিকিৎসা ছাড়া চলতে থাকে, তাহলে এটি হার্ট ফেইলিউর বা হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণ হতে পারে। চিকিৎসার জন্য সাধারণত ওষুধ, ডিভাইস (যেমন: পেসমেকার বা আইসিডি) বসানো এবং কিছু ক্ষেত্রে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট প্রয়োজন হতে পারে।
কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ
কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ হলো জন্মগত হৃদরোগ, যেখানে শিশুর হৃদযন্ত্র জন্মের সময় থেকেই ত্রুটিযুক্ত থাকে। এটি হার্টের ভালভ, দেয়াল বা ধমনীর গঠনে সমস্যা তৈরি করতে পারে, যার ফলে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। কিছু সাধারণ জন্মগত হৃদরোগের মধ্যে রয়েছে সেপ্টাল ডিফেক্ট (হৃদযন্ত্রের দেয়ালে ফুটো থাকা), টেট্রালজি অব ফেলট (Tetralogy of Fallot), ট্রান্সপোজিশন অব গ্রেট আর্টারিজ (Transposition of the Great Arteries) ইত্যাদি।
এই রোগের লক্ষণ শিশুর বয়স অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। নবজাতকদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের রঙ নীলচে হয়ে যাওয়া (Cyanosis), খাওয়ার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি দেখা যায়। বড়দের ক্ষেত্রে ব্যায়ামের সময় অতিরিক্ত ক্লান্তি, বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ থাকতে পারে। চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার, ক্যাথেটার-ভিত্তিক চিকিৎসা, ওষুধ বা কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হতে পারে।
পেরিকার্ডাইটিস
পেরিকার্ডাইটিস হলো হৃদযন্ত্রকে ঘিরে থাকা পর্দার (Pericardium) প্রদাহ, যা সাধারণত ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, ব্যাকটেরিয়া, অটোইমিউন রোগ, কিডনি সমস্যার কারণে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে হার্ট সার্জারি বা হার্ট অ্যাটাকের পরেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পেরিকার্ডাইটিসের প্রধান লক্ষণ হলো বুকের ব্যথা, যা শ্বাস নেওয়ার সময় বা শরীরের ভঙ্গি পরিবর্তনের সময় আরও তীব্র হয়। এছাড়া, জ্বর, ক্লান্তি, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট ও বুকে ভারী অনুভূতি হতে পারে। এই রোগের চিকিৎসার জন্য সাধারণত প্রদাহনাশক ওষুধ, ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক এবং মারাত্মক ক্ষেত্রে পেরিকার্ডিয়াল ট্যাপ বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।
অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন
অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে হৃদযন্ত্রের উপরের দুটি চেম্বার (আ্যাট্রিয়া) অনিয়মিতভাবে সংকুচিত হয়, যার ফলে রক্তপ্রবাহ অস্বাভাবিক হয়ে যায়। এটি রক্ত জমাট বাঁধার (Blood Clot) ঝুঁকি বাড়ায় এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, কার্ডিওমায়োপ্যাথি ও বয়সজনিত কারণ এই রোগের জন্য দায়ী।
এর লক্ষণগুলোর মধ্যে বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দন অন্যতম। চিকিৎসার জন্য ব্লাড থিনার, হার্ট রেট নিয়ন্ত্রণের ওষুধ, ক্যাথেটার অ্যাব্লেশন এবং কিছু ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক কার্ডিওভারশন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
পালমোনারি হাইপারটেনশন
পালমোনারি হাইপারটেনশন হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে ফুসফুসে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীগুলোতে রক্তচাপ বেড়ে যায়, যা হার্টের ডান পাশের অংশের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। এটি জন্মগত হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, ফাইব্রোসিস, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) বা অজানা কারণে হতে পারে।
এর লক্ষণগুলোর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, বুক ব্যথা, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি এবং পা ফুলে যাওয়া অন্তর্ভুক্ত। পালমোনারি হাইপারটেনশন যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তবে এটি হার্ট ফেইলিউরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। চিকিৎসার জন্য সাধারণত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ, অক্সিজেন থেরাপি, রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধের ওষুধ ও কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা হয়।

হার্টের সমস্যা প্রতিরোধে করণীয়
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গড়ে তোলা
একটি সুস্থ হার্টের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনিয়মিত জীবনযাত্রা, যেমন রাত জাগা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ নেওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ঘুমানো, সকালের নাস্তা না বাদ দেওয়া এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করা হলে হার্টের সুস্থতা বজায় রাখা সহজ হয়। বিশেষ করে, সকালের সূর্যালোক শরীরে ভিটামিন ডি সরবরাহ করে, যা হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী।
এছাড়া, নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো বা হালকা ব্যায়াম করলে হৃদযন্ত্র শক্তিশালী হয় এবং রক্তচলাচল স্বাভাবিক থাকে। পাশাপাশি, কাজের মধ্যে মাঝে মাঝে বিরতি নেওয়া, পরিবারের সঙ্গে ভালো সময় কাটানো এবং পছন্দের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে, যা হৃদযন্ত্রের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুস্থ জীবনযাত্রা বজায় রাখার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সুষম খাদ্য ও শারীরিক ব্যায়াম
সুষম খাদ্য হৃদরোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চর্বি ও কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ করলে ধমনীগুলোতে ফ্যাট জমতে পারে, যা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই খাদ্য তালিকায় সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ এবং আঁশযুক্ত খাবার রাখা জরুরি। এছাড়া, চিনি ও লবণ কম গ্রহণ করা, ট্রান্স ফ্যাট ও প্রসেসড ফুড এড়িয়ে চলা উচিৎ।
শুধু সুষম খাদ্য গ্রহণ করলেই হবে না, সেই সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম করাও প্রয়োজন। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো বা ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের অতিরিক্ত চর্বি পোড়ায়, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা
ধূমপান এবং অ্যালকোহল গ্রহণ হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। ধূমপানের ফলে রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয় এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, যার ফলে হার্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এছাড়া, সিগারেটের নিকোটিন এবং কার্বন মনোক্সাইড ধমনীগুলোর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ধূমপান ছেড়ে দেওয়া হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর একটি পদক্ষেপ।
অ্যালকোহলও হার্টের জন্য ক্ষতিকর, বিশেষ করে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে। এটি উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকোহল গ্রহণ করেন, তাদের হৃদযন্ত্রের পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, যা কার্ডিওমায়োপ্যাথির কারণ হতে পারে। তাই হার্টকে সুস্থ রাখতে হলে ধূমপান ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা উচিৎ।
মানসিক চাপ কমানোর উপায় অনুসরণ করা
অতিরিক্ত মানসিক চাপ হৃদযন্ত্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিনের মানসিক চাপের কারণে শরীরে স্ট্রেস হরমোন (কোর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন) বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই নিয়মিত মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ করলে মানসিক চাপ কমে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
এছাড়া, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, প্রকৃতির মধ্যে হাঁটাহাঁটি করা, ভালো বই পড়া, বা সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। হাসি ও আনন্দ হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী, কারণ এটি রক্তচলাচল স্বাভাবিক রাখে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তাই মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য দৈনন্দিন জীবনে কিছু সময় আনন্দদায়ক কাজের জন্য বরাদ্দ করা উচিৎ।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
হৃদরোগ অনেক সময় কোনো লক্ষণ ছাড়াই শরীরে বিকশিত হতে পারে, তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল এবং হার্টের ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটির (ইসিজি) পর্যবেক্ষণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি আগেই চিহ্নিত করা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।
প্রতি ছয় মাস বা এক বছরের ব্যবধানে রক্তচাপ, রক্তের কোলেস্টেরল ও সুগারের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিৎ। যারা হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন, যেমন বংশগতভাবে হৃদরোগ আছে বা অতিরিক্ত ওজন রয়েছে, তাদের আরও বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
উপসংহার
বর্তমানে হৃদরোগ কোন একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি এখন একটি বৈশ্বিক মহামারি। জীবনধারার পরিবর্তন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ কমানো এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা- এই সহজ কিছু অভ্যাস রপ্ত করতে পারলেই আমরা হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারি। মনে রাখতে হবে, হার্টের সমস্যা কোনো আচমকা তৈরি হওয়া একটি রোগ নয়, বরং এটি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এক নীরব ঘাতক। সুতরাং, এখনই সচেতন না হলে হয়তো পরবর্তী শিরোনামে যে আপনার নাম আসবে না তা কে বলতে পারে। তাই চলুন দ্রুত সচেতন হই এবং সঠিক খাদ্যাভাস গড়ে তুলে আমাদের সমাজ থেকে হৃদরোগ নামক মরণব্যাধি দূর করি। ধন্যবাদ।